উৎসব হোক বা ছুটির দিন, অবসর মানেই পরিবার বা বন্ধুর সঙ্গে একটু বাইরে বেড়ানো, কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়া আর আড্ডা। কেনাকাটাও এখন আর শুধু কেনাতেই সীমাবদ্ধ নেই, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রসনাবিলাস আর জম্পেশ আড্ডা। এখন একজন ক্রেতা শপিংয়ে যান শুধু পোশাক বা প্রসাধনী কিনতে নয়; সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে, আড্ডা দিতে বা কিছু মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করতে। ফলে কেনাকাটার পর খাবার এক হয়ে যাচ্ছে।
নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে জেন-জিদের কথাই ধরুন না। তারা শুধু পোশাকই নয়, পোশাকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবেশও খোঁজে। যে শপিং মল বা রেস্তোরাঁয় যাবে, সেটিও যেন তার ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলের সঙ্গে মানায়। তাই ‘ইনস্টাগ্রামেবল স্পেস’ হিসেবে ফ্যাশন আউটলেট ও ক্যাফের যৌথ পরিকল্পনা এখন অনেকটাই জরুরি।
বিশেষত ঈদ বা উৎসবের সময়গুলোয় এই ফুড-ফ্যাশন ফিউশন বেশ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। নতুন প্রজন্মের কাছে আরও একটি বিষয় প্রাধান্য পায়, তা হচ্ছে আড্ডা বা হ্যাংআউট। শহুরে জীবনে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দেওয়ার জায়গার খুবই অভাব। যে অভাব কিছুটা হলেও পূরণ করেছে রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, ফুড কোর্ট।
আড্ডার পাশাপাশি পরিবার নিয়ে ছুটির দিনের বিকেল বা সন্ধ্যার অবসর কাটানোর প্রধান স্থানও হয়ে উঠছে তাই শপিং মল, দোকান–সংলগ্ন ক্যাফে বা ফুড কোর্ট। অর্থাৎ শহরের যেকোনো প্রজন্মের মানুষের কাছে কেনাকাটা, খাওয়া, আড্ডা বা পারিবারিক সময়—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন এক আয়োজন।
বাংলাদেশে অনেক ফ্যাশন ব্র্যান্ডও তাই পোশাকের পাশাপাশি রেস্তোরাঁ ব্যবসার দিকেও ঝুঁকছে। প্রায় দেড় দশক আগে, অর্থাৎ শপিং মলের ধারণা জনপ্রিয় হওয়ার পরই ধারাটি শুরু হয়েছে। একসময় কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি শপিং মলের ফুড জোন দারুণ জনপ্রিয় ছিল।
ধীরে ধীরে আলোচনায় আসে ছোট-বড় আরও কিছু শপিং মলের ফুড জোন বা কর্নার। আর বসুন্ধরা শপিং মলে শুরু থেকেই দারুণ জনপ্রিয়তা পায় তাদের ফুড জোন। বলা যায়, সব শ্রেণি-পেশার মানুষই লুফে নেয় একই সঙ্গে কেনাকাটা ও খাওয়াদাওয়ার এ ধারণা।
এ শপিং মলে অবশ্য আরও একটি বিষয় পরে যুক্ত হয়, আর তা হচ্ছে ছোট-বড় সবার বিনোদনের ব্যবস্থা। অর্থাৎ উন্নত বিশ্বের মানুষের কাছে শপিং বলতে যে বৃহৎ ধারণা বোঝায়, তার সঙ্গে এ দেশের মানুষের পরিচয় ঘটে। পরে রাজধানীর পাশাপাশি বিভাগীয় জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে এই ধারণা।
এখন রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্ক, সেন্টার পয়েন্ট, মাসকট প্লাজা, শ্যামলী স্কয়ার, সীমান্ত স্কয়ার, পলওয়েল কারনেশন ইত্যাদি শপিং মল কেনাকাটার পাশাপাশি ফুড কোর্টের জন্য জনপ্রিয়।
পশ্চিমা বিশ্বে এই ধারা অনেক আগেই ছিল। শুধু শপিং মলেই নয়, ইউরোপ-আমেরিকার বহু আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড নিজেদের আউটলেটগুলোতেও চালু করেছে কফি শপ, বেকারি বা হাই এন্ড রেস্তোরাঁ। এ তালিকায় রয়েছে আরমানি, গুচি, শ্যানেল, ডিওর, ভারসাচে, রাল্ফ লরেনের নাম।
ইতালিয়ান বিলাসবহুল ফ্যাশন হাউস আরমানির রয়েছে নিজস্ব রেস্তোরাঁ ও কফি শপ। মিলান, দুবাই, টোকিওসহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে তাদের ফ্ল্যাগশিপ স্টোরের সঙ্গে রয়েছে ‘আরমানি ক্যাফে’। ফ্লোরেন্স, লস অ্যাঞ্জেলেস ও টোকিওতে গুচি তাদের ফ্ল্যাগশিপ ব্র্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছে একটি মিশেলিন মানের স্টার রেস্তোরাঁ ‘গুচি ওস্তেরিয়া’, যা পরিচালনা করেন বিখ্যাত শেফ মাসিমো বোত্তুরা।
প্যারিসভিত্তিক বিলাসবহুল ফ্যাশন ব্র্যান্ড শ্যানেল টোকিওর শিবুয়ায় তাদের আউটলেটের সঙ্গে যুক্ত করেছে ‘বেইশ’ নামের একটি ফাইন ডাইনিং রেস্তোরাঁ। এটিও পরিচালনা করেন একজন মিশেলিন-স্টার, শেফ। ডিওর তাদের বিভিন্ন দেশের স্টোর যেমন সিউল, মায়ামি বা দুবাইতে চালু করেছে ‘ডিওর ক্যাফে’। যেখানে অতিথিরা উপভোগ করতে পারেন চা, কফি ও হালকা খাবার। এসব উদাহরণ থেকে পরিষ্কার—কেনাকাটা এখন শুধু প্রয়োজন নয়, একটি অভিজ্ঞতা।
আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো পোশাকের বাইরেও এমন পরিবেশ তৈরি করছে, যেখানে ক্রেতারা খাওয়া ও আড্ডা দেওয়ার জন্য সময় কাটাতে পারছেন।
আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডের এই ঢেউ বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশেও আসতে শুরু করেছে। শপিং মলগুলো তো এমনিতেই বড় জায়গা নিয়ে করা, ছোট ছোট বুটিক বা ফ্যাশন হাউসগুলোর সঙ্গেও এখন বানানো হচ্ছে ক্যাফে। কেনাকাটা শেষে অনেকেই এখানে এক কাপ কফি বা চা খেয়ে যান।
কিছু জনপ্রিয় পোশাক ব্র্যান্ডের আউটলেটের একদিকে পোশাক আর অন্যদিকে সেই ব্র্যান্ডেরই ছায়ায় তৈরি করা হয়েছে আর্ট-ক্যাফে বা থিম রেস্তোরাঁ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আড়ং, যাত্রা বিরতি, প্রবর্তনা, মাদল, টিনা অ্যান্ড আরুহিস ক্যাফে, শেফস টেবিল, ভারগো উল্লেখযোগ্য। আবার কিছু ব্র্যান্ড চালু করেও পরে বন্ধ করে দিয়েছে। এ তালিকায় আছে দেশীদশ, খুঁত ও ইয়েলো ক্যাফের নাম।
এর পরও নতুন–পুরোনো অনেক ব্র্যান্ড এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে। এ উদ্যোগ শুধু ব্যবসায়িক নয়; বরং একটি অভিজ্ঞতাও তৈরি করে। ব্র্যান্ডিংয়ের ভাষায় যাকে বলা হয় ইমারসিভ ব্র্যান্ডিং। এটি এমন এক ধরনের অভিজ্ঞতা, যেখানে ভোক্তা শুধু পোশাক নয়; বরং একটি জীবনধারাকেই আপন করে নেয়।
দেশীয় এই ক্যাফেগুলোতে চা, কফি, থাই খাবার, ফুচকা, স্যুপ, পাকোড়া, ডালপুরি, পিঠা, ভেগান খাবার, স্যান্ডউইচসহ দেশীয় ঘরানার খাবার পাওয়া যায়। থাকে সেট মেনুও।
এ ট্রেন্ড আমাদের আরও একবার বুঝিয়ে দিচ্ছে, ফ্যাশন আর ফুড এখন আর আলাদা নয়, একে অপরের পরিপূরক। হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বড় ফ্যাশন হাউসগুলোও তাদের লাইফস্টাইল ব্র্যান্ডে অন্তর্ভুক্ত করবে বুটিক হোটেল, গ্যাস্ট্রোনমিক ডাইনিং অথবা পপআপ রেস্তোরাঁ।